কৃষিপণ্য রপ্তানি : সম্ভাবনা, সমস্যা ও উত্তরণের উপায়
কাজী আবুল কালাম
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশের অর্থনীতিতে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১৩% এবং কৃষি খাতে প্রায় ৪১% শ্রমশক্তি নিয়োজিত আছেন। ফলে দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পেলেও কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাত, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকের শ্রমে কৃষিতে এক অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে সে বিষয়ে আহ্বান জানিয়েছেন। কৃষকগণ আবাদযোগ্য জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, কৃষি খাতে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা এবং কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের সার্বিক দিকনির্দেশনায় কৃষি বর্তমানে একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এ কারণেই কৃষকগণ প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির পাশাপাশি বিপুল পরিমাণে শাকসবজি এবং ফলমূলের আবাদ করছেন। ফলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন শাকসবজি ও ফলমূল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করছে।
কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হলেও এর পরিমাণ ও আর্থিক মূল্যমান মোট রপ্তানির উল্লেখযোগ্য নয়, যদিও ক্রমান্বয়ে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন নতুন পণ্য যুক্ত হচ্ছে এবং প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যও রপ্তানির তালিকায় অধিকহারে যুক্ত হচ্ছে। প্রথমবারের মতো ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ বিলিয়ন ডলার কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে। সারনি-১ হতে দেখা যায় যে, কৃষিপণ্য বিভিন্ন বছরে ধারবাহিকভাবে রপ্তানি হয়েছে এবং রপ্তানির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। আশা করা যায় সকলের প্রচেষ্টায় কৃষিপণ্য রপ্তানির এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শাকসবজি এগিয়ে আছে। তবে ফলমূলও রপ্তানির ক্ষেত্রে আগামী দিনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ হতে নানাবিধ কৃষিপণ্যসমূহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এরমধ্যে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চা পাতা, আম, কাঁঠাল, লেবু, লিচু, লটকন, আমড়া, পেয়ারা, শুকনা বরই, হিমায়িত সবজি আলু, কচু, পটোল, মুখীকচু, লাউ, পেঁপে, শিম, করলা, কাকরুল, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, গুড়া মসলা, কালিজিরা, হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, শুকনা মরিচ, বিরিয়ানী
মসলা, কারি মসলা, ড্রিংকস, বিস্কুট, চানাচুর, সেমাই, পটেটো ফ্লেকস, নুডলস, ড্রাই কেক, মুড়ি, চিড়া, ফুড স্টাফ প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বাংলাদেশ হতে যে সকল দেশে শাকসবজি রপ্তানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও নেপাল এবং যে সকল দেশে ফল রপ্তানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো- কাতার, ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, সৌদি আরব ও অস্ট্রেলিয়া।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশও শাকসবজি এবং ফলমূল বিদেশে রপ্তানি করে। অন্যান্য দেশের রপ্তানির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ এখনও কৃষিপণ্য রপ্তানির বাজারে উল্লেখযোগ্য দেশ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেনি। সারণি-২ থেকে এ বিষয়ে ধারণা লাভ করা যেতে পারে।
কৃষিপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনার পাশাপাশি অনেক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো পণ্য রপ্তানির নিমিত্ত বিমানে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় স্পেস না পাওয়া। এছাড়াও বিভিন্ন পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় টেস্ট করার নিমিত্ত পরীক্ষাগারের অভাব, বিমানবন্দরে হিমাগারের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকা, বিভিন্ন কৃষিপণ্যের কাক্সিক্ষত জাতের অভাব, ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সহজীকরণ ইত্যাদি। এর পাশাপাশি এঅচ, এঐচ এবং এগচ কার্যক্রম শুরু করা, আমদানিকারক দেশসমূহের বিভিন্ন পণ্য বিষয়ে কি কি চাহিদা রয়েছে সে বিষয়ে তথ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ নতুন নতুন বাজার অন্বেষণ করা আবশ্যক।
সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিদেশে শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানি এবং আলু রপ্তানির নিমিত্ত রোডম্যাপ প্রস্তুত করার জন্য ২টি কমিটি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে উভয় কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। উভয় কমিটি কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করেছে। এক্ষেত্রে গুণগত মানসম্পন্ন ও নিরাপদ সবজি ফল উৎপাদন, শ্যামপুরস্থ প্যাক হাউজের কার্যকর ব্যবহার, বিমানে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে স্পেস বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যর জন্য বিমান বন্দরে পৃথক গেট ও স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করা, বিমানবন্দরে ইঅউঈ-এর ক্লোড বেটারেজের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে আনা, কৃষিপণ্য পরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি, পণ্য রপ্তানির জন্য প্যাকেজিং এর মান বৃদ্ধি, আলুর উন্নত জাতের সরবরাহ বৃদ্ধি, বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা বৃদ্ধি, দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরীক্ষাগার তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, সরকার কৃষিপণ্য রপ্তানির জন্য ২০% প্রণোদনা প্রদান করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় হতে ইতোমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে পূর্বাচলে একটি আ্যক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা যায় সরকারের বিভিন্নমুখী উদ্যোগ, কৃষকের প্রচেষ্টা, কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকগণের কার্যক্রম ও প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে কৃষিপণ্য রপ্তানির একটি নতুন দুয়ার খুলে যাবে। বাংলাদেশ অচিরেই কৃষিপণ্য রপ্তানি করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও সক্ষম হবে। য়
লেখক : পরিচালক (যুগ্ম সচিব), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। মোবাইল : ০১৭২৭৫৩১১০০, ই-মেইল : ফরৎ.রপভ@ফধস.মড়া.নফ